“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী” সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লিখা এই কবিতার মাধ্যমে ফুলের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এই পৃথিবীতে ফুল ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হাজার বছর ধরেই ফুলকে সৌন্দর্যের প্রতীক ও আধ্যাত্মিক বস্তু হিসেবে ধরা হয়। তাই মানুষ ফুলের ঘ্রাণে মোহিত হয়ে ছুটে যেতে চায় ফুলের রাজ্যে। ঠিক তেমনি একটি গ্রাম হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদী এলাকা। ছোট্ট এই গ্রামটি ফুলের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের আশেপাশের সব জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্ন রকমের ফুলের বাগান রয়েছে। তাই তাজা ফুলের ঘ্রাণ নিতে ও মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য নিজ চোখে উপভোগ করতে দূর দূরান্ত থেকে হাজারো দর্শনার্থী এখানে ভিড় জমান। বিশেষ করে ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বেশি থাকে। ভ্রমণপ্রিয় এবং ছবি তুলতে পছন্দ করা মানুষদের জন্য সাবদি খুবই জনপ্রিয় একটি জায়গা। এদিকে পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর ফলে ফুলচাষীদের ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। বাড়ে দর্শনার্থীদেরও উপস্থিতি।
সরেজমিনে বিভিন্ন ফুল বাগান ঘুরে সারি সারি ফুলের গাছ লক্ষ করা গেছে। এর মধ্যে লাল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ছোট ও মাঝারী ফুল সবুজ পাতায় মোড়ানো অবস্থায় বেড়ে উঠছে। ফুলগুলো কিছুদিন পরই চারদিক থেকে বেড়ে প্রস্ফুটিত হবে। আর তখনই হাওয়ায় ভেসে ভেসে বাহারি ফুলের গন্ধ আসতে শুরু করবে। তখন ফুল বাগানে সামনে গেলে ফুলের গন্ধে ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতোই একটি গ্রামে রূপান্তরিত হবে সাবদি। যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল দেখতে পাওয়া যাবে । কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই তখন চোখ জুড়িয়ে আসবে। ফুলের সুবাস মন ভরিয়ে দেবে। তখন সাবদী ফুলের বাগানে গেলেই দেখা যাবে যেদিকে দু’চোখ যায় দেখা মিলবে ফুল আর ফুল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। ফুলের সুবাস যেন মন ভরিয়ে তুলবে।
ফুলের রাজ্যে মুগ্ধ হয়ে দর্শনার্থীরা কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন, কেউ আবার ফুলের ছবি তোলার পাশাপাশি ভিডিও ধারণ করছেন। কেউ আবার প্রিয় ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে জীবনের সেরা মুহুর্ত কাটাচ্ছেন। কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। তরুণ-তরুণীরা বর্ণিল সাজে যেভাবে সেজে এসেছেন দেখে মনে হবে সাবদীতে ফুল উৎসব চলছে।
তবে এবার ফুল ব্যবসায়ীদের মাঝে অস্বস্তি বিরাজ করছে। বিভিন্ন ফুলের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে নানা অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার বাজার খুবই মন্দা যাচ্ছে তাদের। এ গ্রামে ফুলের বাজার প্রায় কোটি টাকার উপরে। এবার অনেকটাই কম। তাই এবার ফুল ব্যবসায়ীরা চরম হতাশ ও অস্বস্থিতে রয়েছেন।
ঢাকা থেকে আসা ড. মেহজাবীন নামের এক দর্শনার্থী বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি এখানে হলেও আমি থাকি ঢাকাতে। শীতের শেষের দিকে আর বসন্তের শুরুর দিকে এইসময়টায় বিভিন্ন ফুল ফুঁটে। যা দেখতে খুব সুন্দর লাগে। প্রতিবছরই এসময়টায় আমার আসা হয়। নিজের চোখ দিয়ে ফুল দেখি, ভালো লাগে।
পরিবার নিয়ে আসা সুরভী আক্তার নামের এক তরুণী জানান, ফুল একটি পবিত্র জিনিস। যা আমাদের মনকে অনেক ভালো রাখে। ফুল দেখলেও আনন্দ লাগে। আর এখানকার পরিবেশটাও অনেক সুন্দর।
তামান্না রহমান নামের আরেক তরুণী বলেন, মানুষ সুন্দরের পূজারী। আর সৌন্দর্যের প্রতীক হচ্ছে ফুল। আমি গর্বিত এই এলাকায় জন্ম নিয়ে। এখানে বড় হলেও প্রতিবছর না আসলে মনে হয় বড়কিছু মিস করে ফেলেছি। যতোদিন বেঁচে আছি প্রতিবছর এভাবে সাবদিতে ঘুরতে আসবো।
ফুল ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন আশাহত স্বরে বলেন, গতবছর ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকা শাহবাগহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত ফুলপ্রেমীরা ভিড় জমাতেন। তবে এবার তেমন লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জেলা থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা ভিড় জমান সাবদি গ্রামে ফুল ক্রয় করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেমন যাবে ফুলের বাজার আল্লাহই জানেন।
জাকির হোসেন নামের আরেক ফুল ব্যবসায়ী বলেন, এবার পরিস্থিতি খুবই নাজুক। দেশের পরিস্থিতি অনুকুলে না। ফুলের ব্যবসায়ীরা ঝুকি নিতে চাচ্ছেন না। মানুষের পকেট ফাকা। মানুষ অজানা শংকায় দিন পার করছে। ফুলের বাগানে ফুল ব্যবসায়ীদের কাছে যেখানে আগে থেকেই বুকিং থাকত সেখানে একেবারে নাই বললেই চলে। আগে মানুষের জীবন বাচবে তারপর তো বিনোদন। তাই এবার তেমন ফুল ব্যবসা ভাল হবে না।
ফুল ব্যবসায়ী মুকুল হালদার বলেন, দেশের পরিস্থিতি ভাল না। কখন কি হয় বলা মুশকিল। তাই সারা বছর যেহেতু ফুলের ব্যবসাই করি এবার তেমন পুঁজি ইনভেস্ট করছি না। বাজারও খুব মন্দা। ক্রেতাও খুব কম।
বন্দর উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন আরাফাত বলেন, বন্দর উপজেলার সাবদী, মীরকুন্ডি ও দিঘলদী সহ কয়েকটা গ্রামেই এই ফুলের চাষ হয়ে থাকে। এবছর ৮০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রাও এরকমই ছিলো। তবে নগরায়নের কারণে কয়েক হেক্টর জমি কমতে পারে। এ বছর রোজা চলে আসার কারণে কৃষকদের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে যে টার্গেট হয়তো পূরণ হবে না। সর্বোপরি এ বছর ভালো হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া ভালো ছিলো। আমরা তাদের পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করে থাকি।
বন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাসলিমা আক্তার জানান, বছরের বারো মাসই বন্দরের কয়েকটি গ্রামে ফুল চাষ করা হয়। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এ তিনটি দিবসেই প্রায় ৫-৬ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ বৎসর তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে একটু বিপাকে আছেন।
আপনার মতামত লিখুন :