ফরিদ আহমেদ রবিজাতীয় অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা নারায়ণগঞ্জ জেলাটি মূলতঃ শিল্প বাণিজ্যে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য সুপরিচিত। শিল্প বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর জেলাটির অন্তর্ভুক্ত বন্দরেকে ঘিরেই শিল্পায়নের যাত্রা শুরু প্রাচীন কাল থেকে, কালক্রমে যা অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই অর্থে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জের পরিচিতি অনেকাংশে বন্দর কেন্দ্রিক।
নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয় বন্দরের বেশকিছু অঞ্চল সমন্বয়ে যা এখন সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়েছে।বন্দরের বৃহদাংশ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বন্দর চিরদিনই উপেক্ষা আর বৈষম্যের শিকার।
নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বন্দরবাসীর হাহাকার চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বন্দরে এমন কিছু সরকারি বেসরকারি অবকাঠামো রয়েছে যা দেশ ও জাতির কল্যাণে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে দীর্ঘদিন যাবত অথচ প্রাপ্তির খাতায় শুধু শূন্য! শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ বন্দরে রয়েছে দেশের প্রথম মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান বি আই এম টি, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের প্রথম প্রতিষ্ঠান সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড, দেশের একমাত্র ডেক ও ইঞ্জিন কর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ডি ই পি টি সি। পাটকাঠি দ্বারা নির্মিত কাঠের বিকল্প পারটেক্স বোর্ড তৈরির প্রথম কারখানা বন্দরে অবস্থিত। সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বেশকটি কেন্দ্র, বেসরকারি ডকইয়ার্ড, রি রোলিং মিল এবং সিমেন্ট তৈরির বেশকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীর বন্দরে অবস্থিত। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমূহ ছাড়াও এখানে রয়েছে তৈরি পোশাক সহ অন্যান্য অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ভৌগলিক অবস্থান এবং নদী তীরবর্তী হওয়ায় এলাকাটি প্রাচীন কাল থেকেই শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধ।এসব শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই এখানে আসেন কর্ম সংস্থানের উদ্দেশ্যে। মূল শহর নারায়ণগঞ্জে কর্মরত অনেকেই সাশ্রয়ী ভাড়ার কারণে বন্দরে বসবাস করেন। সংগত কারণেই বন্দর পরিণত হয়েছে ধারন ক্ষমতার অধিক জনবহুল অঞ্চলে।বন্দরের অধিকাংশ শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত,তাই শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জ তথা বন্দরের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ বলা যায়। নদীটি দেশের জন্য আশির্বাদ বয়ে আনলেও ধীরে ধীরে তা বন্দরবাসীর জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
নদীটির উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্তে দুটি সেতু থাকলেও তা প্রতিদিন নদী পারাপার হওয়া সাধারণ মানুষের কোন কাজেই আসছে না। জেলা শহর নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকা যাতায়াতের সহজ, অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী একমাত্র পথ ১ নং এবং সংলগ্ন খেয়াঘাট সমূহ।নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার যোগে যাত্রীদের জীবন হাতে নিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। এসব ঘাটে নৌ দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংবাদ নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১নং ঘাট সংলগ্ন কদম রসুল সেতু প্রকল্প একনেকে পাশ হওয়া সত্ত্বে আলোর মুখ দেখলো না! অবকাঠামো নির্মাণের প্রাথমিক সব কাজ শেষ হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। তা হলে সমস্যা কোথায়?সেতু নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতার কারণ হিসেবে দলীয় রাজনীতি এবং দলাদলির কথা বহুল প্রচারিত।এখনতো আর সে সমস্যা নেই।
বর্তমান অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্য নিরসনে এগিয়ে আসবেন, জন গুরুত্ব অনুধাবন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতুটির কাজ শুরু করবেন, তেমনটিই বন্দর তথা সমগ্র নারায়ণগঞ্জ বাসীর প্রত্যাশা।
বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বন্দরবাসী বঞ্চনার শিকার। গ্যাস ও পানি স্বল্পতার কারনে সমগ্র দেশবাসী ভোগান্তি পোহাচ্ছে এ কথা স্বীকার করেও বলতে হয় সংকট নয় অধিকাংশ বন্দরবাসী গ্যাস ও পানি শুন্যতায় ভুগছে। বছরের পর বছর গ্যাস পানি না পেয়ে বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। দুর্ঘটনা বা অসুস্হতা জনিত জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রাপ্তির সামান্যতম সুযোগও এখানে নেই। বিনা চিকিৎসায় বা বিলম্ব জনিত চিকিৎসার কারণে অনেককেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে জনবহুল শিল্প সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল দীর্ঘদিন যাবত এভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে তা নিয়ে ভাবার কেউ আছে বলেও মনে হয় না। থাকলে এমন অবস্থায় পৌঁছুতে হতো না,আগেই প্রতিকার পাওয়া যেতো। কাজের কাজ যা হয়েছে তা কেবল একেক সময় একেক রাজনৈতিক দলের ছেলে ভুলানো আশ্বাস আর আশ্বাস।
সুদীর্ঘকাল যাবত চরম বৈষম্য আর উপেক্ষার শিকার বন্দরবাসীর নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বন্দরবাসীর নাগরিক সমস্যা সমাধানে শৈথিল্যের কারণ হিসেবে বহুল প্রচারিত রাজনৈতিক দলাদলি এবং আন্ত:দলীয় কোন্দলকে সামনে আনার সুযোগ এখন আর নেই। এমন অবস্থায় বন্দরবাসী আশা করতেই পারে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর কাজ যত দ্রুত সম্ভব দৃশ্যমান করা এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হলে তা শুধু বন্দরবাসীর কাজেই আসবেনা উপকৃত হবে সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসী।
কদম রসুল সেতুর বাস্তবায়ন পূর্ব পশ্চিম উভয় অঞ্চলকে একীভূত করে অখন্ডিত শহরে রূপান্তরিত করবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন শিল্পায়ন এবং আবাসনের ফলে কার্যত, অচল বর্তমান মূল শহরের উপর চাপ অনেক কমে যাবে যা প্রকারান্তরে নারায়ণগঞ্জকে গড়ে তুলবে আধুনিক একটি শহর হিসেবে।বন্দরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বন্দর সহ সম্প্রসারিত নারায়ণগঞ্জ হবে প্রকৃত অর্থেই স্বপ্নের শহর। বন্দরবাসীর দু:খ লাঘবে বর্তমান সরকার এগিয়ে আসবেন,অবসান হবে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা,উপেক্ষা আর প্রতীক্ষার।তেমন সোনালী দিন আদৌ আসবে কি? এমন আশা নিরাশার দোলাচলে আর কত কাল কাটাতে হবে বন্দরবাসীকে? উত্তরের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে এলাকাবাসী।
আপনার মতামত লিখুন :