News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

জীবনযুদ্ধে হার মানেনিন ৪ দশকের ফল বিক্রেতা বৃদ্ধা ফজিলাতুন


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | স্টাফ রিপোর্টার প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৫, ১০:৫৭ পিএম জীবনযুদ্ধে হার মানেনিন ৪ দশকের ফল বিক্রেতা বৃদ্ধা ফজিলাতুন

৪ দশক ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যস্ততম ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় মৌসুমি ফল বিক্রি করে আসছেন বৃদ্ধা ফজিলাতুন। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়লেও এখনো কাপা কাপা হাতে ফল কেটে বিক্রি করে চলেছেন। নিজের বোঝা নিজেই বহন করাসহ সব কিছুই করছেন তিনি। তাঁর হার না মানা মানসিকতা ও কর্মঠ জীবনের জন্য তিনি পরিচিত শহরের কিশোর, তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধদের কাছেও। তার চেয়েও অনেক কম বয়সের নারীরা যেখানে মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে খান সেখানে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম বৃদ্ধা ফজিলাতুননেছা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি এলাকায় আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের পাশে নাসিকের মালিকানাধীন দোয়েল সিটি প্লাজার সামনে প্রতিদিন একটি থালায় কিছু মৌসুমি ফল নিয়ে বসেন ফজিলাতুন। গায়ে প্রিন্টের ছাপা শাড়ি। পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। প্লাস্টিকের বেঞ্চে বসে কাপা কাপা হাতে থালায় রাখা ফলের খোসা ছাড়াতে দেখা যায় তাকে। অপর একটি কৌটায় থাকে বিট লবণের গুড়। কাপা কাপা হাতে নিজেই ফলের খোসা কেটে বিক্রি করছেন। ক্রেতারা আসলে বিট লবন মাখিয়ে হাতে তুলে দিচ্ছেন। তীব্র রোদ মুষলধারে বৃষ্টি আর ঝঞ্জা বায়ু যাই থাকুক না কেন প্রতিদিন সকালেই তাকে নামতে হচ্ছে জীবনযুদ্ধে।

এই বয়সেও কাজ করছেন এমন প্রশ্নে ফজিলাতুন বলেন, ভিক্ষার থেকে ভাল আছি। ভিক্ষা করুম কেন? ব্যবসার দাম আছে। হাত পাতার দাম নাই। বসতবাড়ির প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, নিজের বাড়ি সাড়ে ৩ হাত। ওইটাই আসল বাড়ি। এখন যে বাড়িতে থাকি সেইটা নকল বাড়ি।   

ফজিলাতুন জানান, তিনি থাকেন নারায়ণগঞ্জ শহরের পাক্কা রোড খানকা গলির মনসুর হাজির বাড়িতে। তার জন্ম চাঁদপুরের মতলবের কদমতলী এলাকায় ভূইয়াবাড়িতে। পাকিস্তান আমল থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জে থাকছেন। স্বামী সন্তানের কথা জানতে চাইলে ফজিলাতুন বলেন, আত্মীয় বলতে পৃথিবীতে তাঁর কেউ নেই। আল্লাহ ছাড়া আমার আর কেউ নাই। স্বামী কবে মারা গেছেন জিজ্ঞেস করতেই ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওয় মারা গেছে অনেক দিন আগে। ওর কথা আর কইয়ো না। অন্য কোন কথা থাকলে কও।’ এখন যেখানে থাকছেন সেটা নিজের বাড়ি কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান বর্তমানে যেখানে ভাড়া থাকছেন সেটা ভাড়া বাড়ি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিজের বাড়ি সাড়ে ৩ হাত। ওইটাই আসল বাড়ি। এখন যে বাড়িতে থাকি সেইটা নকল বাড়ি।   

জীবিকা কিভাবে নির্বাহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমারে আল্লাহই চালায়। ভাতেরও কষ্ট নাই কাপড়েরও কষ্ট নাই আল্লাহর রহমতে।’

কত বছর ধরে এখানে ফল বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে এখানে ফল বিক্রি করছেন। সেই এরশাদের আমল থেকে। আগে মানুষের বসতবাড়িতে কাজ করতেন। এরশাদের আমলে প্রথম ফল ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিদিন ফল বিক্রি করে যা আয় করেন তাতে ঘর ভাড়া খাবার খরচ তার চলে যায়।

কেউ সহযোগিতা করে কিনা এমন প্রশ্নে ফজিলাতুন বলেন, ভিক্ষার থেইকা ভাল আছি। ভিক্ষা করুম ক্যা? আমরা ভিক্ষা করার মানুষনা। আমাগো বাড়ির ভাত খাইছে পরে আজকা কপাল দোষে সেই বাড়ির মাইযা আমি রাস্তায়। আমার বাপে কোলকাতা, করাচি, লাহোর, বিলেত, দিল্লি ৭ তলা জাহাজের ট্যান্ডল আছিল। সেই বাড়ির মাইয়া আমি। ভুলের কারনে বাপের ২ পা কাটা পড়ে। এভাবেই নিজের পরিবারের গল্প বলতে গিয়ে আবেগাপ্লæত হয়ে পড়েন ফজিলাতুন।

বয়স জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বয়স ১০০ এর উপরে। আমি ৫ সের তেল ৫ সিকা বেচছি। সেইটা দিয়া নানীর লাইগা পান সুপারী আইনা বাকী পয়সা রাইখা দিসিলাম। তামার পয়সা যার মধ্যে ছিদ্র ছিল। সেই পয়সা কি এখনো আছে? ওই আমলের মাইয়া আমি।

তিনি আরো বলেন, যখন যে মৌসুমে ফল আসে সেটা বিক্রি করেন। আবার আমের দিনে আম। তিনি ব্যবসা করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসার দাম আছে। হাত পাতার দাম নাই। অনেকেই আমাকে দেখিয়ে বলে জুয়ান জুয়ান মাইয়ারা ভিক্ষা করে আর হের মতো মানুষে ব্যবসা করে।

এক ক্রেতা বলেন, আজকে উনার অনেক বয়স হলেও তিনি কাজ করে খাচ্ছেন অথচ কম বয়সের নারীরা ভিক্ষা করছে। তার মতো মানসিকতার হলে ভিক্ষুক বাংলাদেশে থাকতোনা। 

দ্বিগুবাবুর বাজারের মুরগী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, উনাকে দীর্ঘদিন ধরে এখানে মৌসুমী ফল বিক্রি করতে দেখছি। আমি তাকে জিজ্ঞাস করসিলাম। উনি বলেন, নবীজীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা। উনি আজীবন কর্ম করে খাবেন। স্বামী সন্তানের কথা জিজ্ঞাস করলে তিনি এড়িয়ে যান তখন ধারনা হয়েছিল হয়তো স্বামী সন্তান থাকলেও হয়তো তার খোঁজখবর নেয়না। তিনি আরো বলেন, এখন জুয়ান জুয়ান মহিলারা হাত পাতলে পায়। তারা নানা কৌশলে হাত পাতে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবসা করে। অথচ ওইসব নারীদের তার কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ ভিক্ষা না করে ব্যবসা করা।

শহরের নয়ামাটির হোসিয়ারী মালিক আব্দুল খালেক বলেন, ৪০ বছর ধরে উনাকে ফল বিক্রি করতে দেখছি। কখনো হাত পাততে দেখিনি। উনি যে কখনো হাত পাতেন না নিজে ব্যবসা করেন এটা দেখে অনেক ভাল লাগে।

গোগনগরের বাসিন্দা আব্দু রউফ বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর থেকে তাকে এখানে দেখছি ফল বিক্রি করতে। ১৯৮৭ সালে আমি যখন সরকারি তোলারাম কলেজে পড়ি তখনও তাকে এখানে ফল বিক্রি করতে দেখেছি। তখন আমি একবার তাকে ৫০ টাকা ১০০ টাকা দিতে চেয়েছি কিন্তু তিনি নেননি। তিনি শুধু তার জন্য দোয়া করতে বলেছেন। আজকে অনেককে দেখি নানা অজুহাতে ভিক্ষা করে যা মোটেও ঠিক নয়। আজকে বৃদ্ধা ফজিলাতুনকে দেখে আমি গর্ব বোধ করি।

Islam's Group