মায়ের অসুস্থতার কারণে হাইস্কুলের গন্ডি না পেরোতেই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিল শুভ চন্দ্রকে। যে কারণে নিজের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি শুভ চন্দ্র দাস। তবে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও দীর্ঘ ৯ বছর ধরে পথশিশুদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন শুভ। তারই হাত ধরে ইতোমধ্যে কয়েকজন পথশিশু পার হতে চলেছে হাইস্কুলের গন্ডি।
জানা গেছে, প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে খোলা আকাশের নিচে সমাজের দরিদ্র, ছিন্নমূল-অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে বিনামূল্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রম এক পাঠশালা। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম লাল সবুজের পতাকা শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয় নামে পরিচিত। অস্থায়ী এই পাঠশালার উদ্যোক্তা ও পাঠদানকারী শিক্ষক শুভ চন্দ্র দাস নামের একজন যুবক। রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমের শেষপ্রান্তে খোলা আকাশের নিচে পরিচালিত হচ্ছে শুভ চন্দ্রের স্কুল। একটি টংঘরে রক্ষিত থাকে সাদা বোর্ডসহ শিক্ষা সামগ্রী। এর সামনে কয়েকটি বেঞ্চে বসে পাঠ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনের মতো বেলা ৫টার পরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত ও শপথ বাক্য পাঠ করানোর মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এসব কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে শুভ নিজের উপার্জন থেকে ও বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনের পক্ষ থেকে বই, খাতা-কলমসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণও দিয়ে যাচ্ছে। স্কুলটিতে নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, অংক, ইংরেজি সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়।
অস্থায়ী পাঠশালার উদ্যোক্তা ও পাঠদানকারী শুভ চন্দ্র দাস বলেন, আমার পরিবারে দুই ভাই ও এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই। মা-বাবাও নেই। আমার ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে শিক্ষক হবো। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা ও অভাবের তাড়নায় বেশিদিন লেখাপড়া চালাতে পারিনি। তবে সবসময়ই চিন্তা করতাম নিজে একটা বিদ্যালয় করবো। চাষাঢ়া রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসার পরে পরিকল্পনা করেন ছিন্নমূল পথ শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিবো। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের শুরুর দিকে কয়েকজন পথশিশুকে বিনামূল্যে শিক্ষা নিতে রাজী করান। পথশিশুদের রাজী করাতে তাদের নানা স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন শুভ। লেখাপড়া শিখলে অনেক বড় হতে পারবে এমন স্বপ্ন দেখায় পথশিশুদের। তার দেখানো স্বপ্ন পূরণে প্রথমে রাজি হয় ১১ জন পথশিশু। তখন তিনি (শুভ) শহরের একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। বেতন পেয়ে বেশ কিছু আদর্শলিপি ও বসার জন্য পাটি ক্রয় করে ওই বছরের ১১ মার্চ শুরু করেন শুভ। এরপর থেকে গত ৯ বছর ধরে পথশিশুদের স্বপ্নপূরণে পাঠদান করে যাচ্ছেন শুভ। শুভ জানান, নিজের বেতনের টাকার একটি অংশ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করেন। সরকারি তোলারাম কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ লায়ন্স ক্লাব, রোটারী ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেও এখনো স্কুলটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। মাথার উপরে খোলা আকাশ থাকায় ঝড় বৃষ্টিসহ প্রতিক‚ল পরিবেশেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৫ জন। ইতোমধ্যে তার স্কুলের ২ জন শিক্ষার্থী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে পড়ছে। একজন আমলাপাড়াস্থ নারায়ণগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ও আরেকজন ইসদাইর রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছে। শুভ আরো বলেন, স্কুলটির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও মাথার উপরে একটি ছাদ হোক সেটা তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এ বিষয়ে প্রশাসন ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। স্কুলটির পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তারা এখানে বিনামূল্যে লেখাপড়া করছেন। শুভ স্যার কোন টাকা নেয়না বরং বিনামূল্যে বই খাতাসহ সবকিছু দেয়। তারা এখানে পড়তে পারায় খুশি। অভিভাবকরা জানান, তারা নিম্নবিত্তের মানুষ। তারা কাজ করে যা উপার্জন করেন তাতে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারেন না। শুভ স্যারের স্কুলে বিনামূল্যে লেখাপড়া করতে পারায় তারা খুশি। স্কুলটি ভাল মতো চলুক একটি ভবন হোক এটা তাদের প্রত্যাশা।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, রেলস্টেশনের আশেপাশের এলাকায় অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের বসবাস। তাদের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। শুভ স্যার অনেক ধরে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে বিত্তবানদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সরকারকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান।
আপনার মতামত লিখুন :