রাজধানী ঢাকার লগোয় বাণিজ্য নগরী নারায়ণগঞ্জেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম হলেও থেমে নেই ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরে দু’টি সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলাগুলোতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও এসব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে রয়েছে নানাবিধ অভিযোগ। নানা অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যায়না বেশিরভাগ আক্রান্ত রোগী। তেমনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। নারায়ণগঞ্জ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ১১ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে আড়াই হাজার। অথচ এই তথ্য নিয়েও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। নারায়ণগঞ্জের প্রধান ৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই গত এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।
জানা গেছে, বৃষ্টি বা পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমেও ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব কমছে না। চলতি বছরে নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও প্রতিরোধে দেখা যায়নি কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ। নাসিকের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানো হলেও সেটাকে আইওয়াশ বলছেন নগরবাসী। অপরদিকে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দালালদের দৌরাত্ম্য, চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যসহ নানাবিধ কারণেও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যে কারণে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের ভিড় ক্রমশই বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করেও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এনএস-১ টেস্ট করাচ্ছে জ¦র আক্রান্ত রোগীরা। ঘন ঘন প্লাটিলেট পর্যবেক্ষণের জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। রোগীদের জন্য টক জাতীয় ফল এবং ডাবের চাহিদা থাকায় এসবের দামও বাড়ছে প্রচুর।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৬১৪ জন। জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে নারায়ণগঞ্জে এ যাবৎ কোন মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত প্রধান ৪টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শুধুমাত্র গত নভেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বিবি রোডে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মার্কেটিংয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বাবর জানান, প্রতিদিন কয়েকশ’ রোগী জ¦র নিয়ে ডেঙ্গুর এনএস-১ পরীক্ষা করাচ্ছেন যার মধ্যে আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ জন ডেঙ্গু পজেটিভ পাওয়া যাচ্ছে। তবে গত এক মাসে কি পরিমাণ পরীক্ষা হয়েছে ও কি পরিমাণ আক্রান্ত হয়েছে সেটা আমাদের ম্যানেজমেন্ট বলতে পারবে। এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির এজিএম স্বপনকে কল করা হলে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন জানিয়ে কল কেটে দেন।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বালুরমাঠে অবস্থিত মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার সাইফুল্লাহ টিপু জানান, গত নভেম্বর মাসে মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অন্তত ৫ হাজার জন এনএস-১ টেস্ট করিয়েছেন। তার মধ্যে ডেঙ্গু পজেটিভ পাওয়া গেছে অন্তত ১৫০০ জনকে।
শহরের বিবি রোডে অবস্থিত মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার হিমেল জানান, প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ জনের মতো রোগী এনএস-১ পরীক্ষা করাচ্ছেন। তার মধ্যে ডেঙ্গু পজেটিভের হার ২০ পারসেন্ট।
শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত ল্যাব এইডের ম্যানেজার মাসুমুল হক সোহেল জানান, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী এনএস-১ পরীক্ষা করাচ্ছেন। তার মধ্যে ডেঙ্গু পজেটিভ পাওয়া যাচ্ছে ৫ থেকে ১০ জনকে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতির কোনরূপ উন্নতি আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। কোন ওয়ার্ডেই তাদের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। হাসপাতালগুলোতে নামেমাত্র বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ড থাকলেও বেড, মেডিসিন ও মেডিকেল যন্ত্রাংশের পর্যাপ্ত নয়। নোংরা, অপরিষ্কার বিচ্ছিরি পরিবেশের কারণে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আমরা হাসপাতালগুলোর পরিবেশ উন্নতির জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও পরিবেশের কোন উন্নতি চোখে পড়েনি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ড. এ এফ এম মুশিউর রহমান বলেন, আমরা শুধু সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আগত রোগীদের তথ্য সরবরাহ করে থাকি। বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এনএস-১ পরীক্ষার তথ্য আমাদের রিপোর্টে নেই। তিনি আরো বলেন, আমাদের পরীক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। হাসপাতালেও রোগীদের চিকিৎসা সঠিকভাবে চলছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বেড খালি রয়েছে। অত্র জেলার কোন সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত কোন রোগী মারা যায়নি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, নাসিকের মশার ওষুধ ছিটানো, সচেতনতামূলক কর্মসূচিসহ নানা কার্যক্রম চালু রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন মশক নিধন কর্মীসহ আমাদের ২০ জনের স্পেশাল টিম রয়েছে যারা বিভিন্ন স্থাপনায় ডেঙ্গু মশার লার্ভা রয়েছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এবছর কিন্তু ডেঙ্গু প্যাটার্ন বদলেছে। মশার ওষুধ ছিটানোর পরেও কেন ডেঙ্গু বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক যেমন বেশি খেতে খেতে অ্যাডাপটেশন হয়ে যায় তেমনি মশার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে কিনা সেটা জাতীয়ভাবে গবেষণার বিষয়। আমাদের কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছি মিশ্রনে ওষুধের পরিমাণটা বাড়িয়ে দেয়ার জন্য।
আপনার মতামত লিখুন :