মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের প্রাণ খ্যাত শীতলক্ষ্যা নদী। নদীটিতে দূষণের পরিমান এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এই নদীতে একটু বেশি পরিমান ঘুর্ননে অনেকটা ডিটারজেন্ট মেশানো পানির মত ফেনা উঠতে শুরু করেছে। নদীতে চলাচলকারী লঞ্চ ও বড় বড় জাহাজের পাখার ঘুর্ননের সাথে সাথে নদীর ডিটার্জেন্ট মেশানো পানির মত ফেনা সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিনে শীতলক্ষ্যা নদীর এমন দৃশ্য অনেকেই অবাক করেছে। তবে এই নদীটির দূষন নিয়ে একেরারেই উদাসিন সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর সহ নারায়ণগঞ্জের বড় বড় কল-কারখানার মালিক সহ সাধারণ মানুষও। প্রতিনিয়তই যার যেভাবে ইচ্ছা নদীটি দূষন করে যাচ্ছে।
তথ্য মতে, শীতলক্ষ্যা হলো ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখানদী। এর উপরের প্রবাহের একটি অংশ বানার নদী বা বানোর নদী নামে পরিচিত। শীতলক্ষ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে, এটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয় এবং তারপর মধ্য বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরের পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। নদীটি প্রায় ১১০ কিলোমিটার (৬৮ মাইল) লম্বা এবং প্রস্থে নারায়ণগঞ্জেই সব থেকে কাছে, (৩০০ মিটার)। নদীটি দিয়ে সারা বছরই নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে। শীতলক্ষ্যা নদী গাজীপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং কিছু দূরত্ব নরসিংদীর সাথে সীমানা তৈরি করেছে এবং তারপর নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক ম্যাথিউস ভ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রে , নদীটিকে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমে প্রবাহিত লেকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভ্যান ডেন ব্রুকের সময়ে (১৬৬০), এটি একটি বৃহৎ এবং দ্রæত প্রবাহিত নদী ছিল। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে পর্যন্ত এটি তাই ছিল।
এই অঞ্চলের প্রাক্তন রাজধানী সোনারগাঁও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এই অঞ্চলের প্রাক্তন শাসক ঈসা খান নদীর তীরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় এটি একটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে সংযুক্ত ছিল। নদীর তীরে অবস্থিত সোনাকান্দা দুর্গটিও মগ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের মোকাবেলা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল।
শীতলক্ষ্যা নদী একসময় মসলিন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। আজও, এর তীরে শৈল্পিক বয়ন কেন্দ্র রয়েছে। এর তীরে আদমজী পাটকল( বর্তমানে আদমজী ইপিজেড) সহ বেশ কয়েকটি শিল্প ইউনিট রয়েছে এবং সিদ্ধিরগঞ্জে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি অবস্থিত ।
এই নদীর তীর ধরে অসংখ্য লঞ্চ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে। সরকার বিদেশি বিনিয়োগে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারকবাহক শীতলক্ষ্যা নদী। যে নদীকে ঘিরেই জেলার গোড়াপত্তন। এই শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই প্রায় ৪০০ বছর আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর হিসেবে গড়ে ওঠে প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ। এখানে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের শিল্পকারখানা।
স্বার্থান্বেষী মহলের দখল আর দূষণের কবলে পড়ে নদীটি আজ মৃতপ্রায়। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ ও জলজ প্রাণীর বাস উপযোগী। অনেকেই এ নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। রান্না, গোসলসহ বিভিন্ন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করা হতো। ভয়াবহ দূষণের কারণে নদীর পানি ব্যবহার তো দূরের বিষয়, নদী দিয়ে চলাচলই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন প্রচুর মানুষকে কাজে যাওয়ার জন্য শীতলক্ষ্যা পার হতে হয়। নাকে রুমাল চেপেও তীব্র দুর্গন্ধ এড়ানো যায় না। এছাড়াও দূষণের ফলে নদীর আশপাশের এলাকার প্রায় ৫০ শতাংশ জেলের সংখ্যা কমেছে, পেশা পরিবর্তন করেছে অনেকে।
এদিকে দূষণের সাথে দখলে বিপন্ন শীতলক্ষ্যা। নদীর সীমানা পিলারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ডকইয়ার্ড, গোডাউন, কারখানাসহ অনেক অবৈধ স্থাপনা। নদীর পাড় দখল করে প্রভাবশালী মহল বালির আড়ত, অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ব্যবসায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে এরইমধ্যেই বিআইডবিøইটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর এর উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা তীরে কয়েক দফায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের দুই হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানাগুলোর অনেকগুলোতে ইটিপি ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছেনা। এসব কারখানাগুলো রাসায়নিক বর্জ্য, গৃহস্থালীর বর্জ্য ও শহরের সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের একটা বিরাট অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে।
এসব কারণে নদী তীরবর্তী বাতাস ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর পাড় ঘেঁষে ফেলা হচ্ছে পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্য। এসব বর্জ্য আসছে স্থানীয় মার্কেট ও আড়ৎ থেকে। নদীর পানিতে রঙ ধরেছে। স্রোতের সাথে ভেসে চলেছে পলিথিন, ফলের খোসা, প্লাস্টিকের বস্তা, বোতল। কচুরিপানার চেয়ে ময়লার পরিমাণই বেশি। পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র মতে, নারায়ণগঞ্জে তরল বর্জ্য নির্গমন হয় এমন শিল্প-প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৫০টি। এর মধ্যে ১২০টি প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) বসানো হয়নি। আবার ইটিপি আছে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানে ইটিপি ব্যবহৃত হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটাররেরও বেশি অপরিশোধিত শিল্প ও গৃহস্থালির তরল বর্জ্য পড়ছে শীতলক্ষ্যায়। নদীর পানিতে ময়লা ও বর্জ্যের পরিমাণ ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। শীতলক্ষ্যার প্রতি লিটার পানিতে ৪ থেকে ৬ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা থাকলেও আছে ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম। এতে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠেছে নদীটি।
বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা ফোন রিসিভ করেন নি।
আপনার মতামত লিখুন :