২০০৩ এর ১৮ ফেব্রুয়ারী ব্যবসায়ী সাব্বির আলম হত্যার পর থেকে প্রতি বছর বেশ ঘটা করেই মৃত্যুবার্ষিকী পালিত ও এদিন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বেশ জোরালো বক্তব্যও আসে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের র্যালি আর শ্রদ্ধায় স্মরণ হয় সাব্বিরকে। ২০০৮ থেকে পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও রাজপথে সক্রিয় ছিল সাব্বিরের পরিবার ও দুই ভাই তৈমূর আলম খন্দকার এবং মাকছুদুল আলম খন্দকার সহ অনুসারীরা। কিন্তু ২২ বছর পর বিবর্ণ হয়ে গেছেন তারা। গত ৭ জানুয়ারী সাব্বিরের রায় ঘোষণার পর এবারের আয়োজন একেবারেই সাদামাটা। অথচ বিএনপি ক্ষমতায় কিন্তু অতি লোভে তৈমূরের দলত্যাগ করে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে কোনঠাসা খোরশেদ। বিপরীতে উল্লাসিত সাব্বির হত্যায় অভিযুক্তরা। কারণ প্রধান আসামী জাকির খান সহ সকলেই খালাস। ৭ জানুয়ারী তিনি সেই আলোচিত হত্যা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সে খবর পেয়ে কারাগারের গারদখানাতে বেশ উচ্ছ্বাসিত হতে দেখা যায় জাকির খানকে। আপাতত তার মুক্তিতে আর কোন বাধা রইলো না। তবে আরেকটি মামলায় সাজা থাকায় মুক্তি পেতে বিলম্ব হবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জাকির জানান, ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আলোচিত ব্যবসায়ী সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় তার বড় ভাই অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বাদি হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রথমে ৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামী করা হয়। ওই মামলায় জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের নাম ছিলনা। পরে জাকির খানসহ ৮ জনের নামে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। ৫২ জন সাক্ষীর মধ্যে ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত জাকির খানসহ সকল আসামীকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে মামলায় এজাহারনামীয় আসামী ছিলেন ৭ জন। তারা হলেন, জিকু খান, মামুন খান, জঙ্গল ওরফে লিটন, মোক্তার, শাহীন, মনিরুজ্জামান শাহীন, সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের শ্যালক জুয়েল। পরে তদন্তকারী অফিসার সিআইডির পরিদর্শক নুরুল আফসার ভ‚ইয়া ৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। তারা হলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান, তার ভাই মামুন খান, জিকু খান, জঙ্গল ওরফে লিটন, মোক্তার হোসেন ওরফে মোক্তার, মনিরুজ্জামান শাহীন, নাজির আহাম্মদ ওরফে নাজির, মোঃ আব্দুল আজিজ ওরফে বাচ্চু।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট ৩৩টি মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল।
২০০২ সালের ২২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাস, চাঁদা ও মাদক মুক্ত করার জন্য নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সে অনুষ্ঠিত জেলার ৩২ টি ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে সেনাবাহিনীর মত বিনিময় সভায় “আমার জানাযায় অংশ গ্রহণ করার আহবান জানিয়ে বক্তব্য শুরু করছি” বক্তব্যে সন্ত্রাসীদের নাম বলার চার মাসের মাথায় ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী খুন হন ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার। সাব্বির সেদিন নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের নাম, ঠিকানা ও তাদের গডফাদারদের নাম প্রকাশ করেন এবং সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তখন শহীদ সাব্বিরের ব্যাপক তৎপরতায় ঝুট সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, চুন ফ্যাক্টরী ও নারায়ণগঞ্জবাসী নিস্তার লাভ করে।
হত্যাকাণ্ডের পর সুরতহাল ও ময়না তদন্তের রিপোর্টের সূত্র ধরে তখনকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সবগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছিল সাব্বিরের শরীরে ২১টি বুলেটের দাগ রয়েছে। সেই ঘটনার ২২ বছর পর ৭ জানুয়ারী রায় ঘোষণা হয়েছে। এতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন মামলার এজাহারভুক্ত ও পুলিশের দেওয়া চার্জশীটভুক্ত সকল আসামী। ফলে প্রশ্ন উঠেছে কারা ছিল সেই আততায়ী যাদের ২১ বুলেটে নিথর হয়ে যায় সাব্বিরের দেহ।
সাব্বির আলম খন্দকার খুন হয়েছে এটা নিয়ে কারোই সন্দেহ নাই। খুনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন অনেকেই। তখন হাবিবুর নামের একজন গণমাধ্যমে সে বর্ণনাও তুলে ধরেন।
প্রথম আলো, জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারের সংবাদে বলা হয়, ফেব্রুয়ারী সকালে মাসদাইরে নিজ বাড়ির অদূরে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া খন্দকার স্কুল থেকে বের হওয়ার ৫ থেকে ৭ গজ দূরেই আক্রান্ত হন সাব্বির আলম খন্দকার। কালো গেঞ্জি ও ট্রাউজার পরিহিত দুই যুবক প্রথমে সাব্বিরকে লক্ষ্য করে ২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। সাব্বির তখন দৌড় দিলে সন্ত্রাসীরা পেছন থেকে খুব কাছ থেকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য গুলি ছোড়ে। পিঠে, পেটে, মাথায় ও হাতে ২১টি গুলির চিহ্ন রয়েছে। মাথায় গুলি করা হয়েছে তিনটি। একটি গুলি ডান চোখ দিয়ে ঢুখে মাথা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পায়ে হেঁটে মাসদাইরের দিকে চলে যায়। তখন একজন রিকশাচালকও গুলিবিদ্ধ হয়।
২০০৩ এর ১৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০২৫ এর ৭ জানুয়ারী মাঝে বয়ে গেছে ২২টি বছর। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বিচার কাজ শেষে ৭ জানুয়ারী রায়কে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে ছিল এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। নিজ ভুলে অতি লোভে সাব্বিরের বড় ভাই তৈমূর আলম খন্দকার পুরো পরিবারকে বিষিয়ে তুলে নিজে হয়েছেন দেউলিয়া। বিপরীতে মামলার অন্যতম আসামী হয়ে থাকা সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খান হয়েছেন রাজনৈতিক ও ক্ষমতায় শক্তিমান। গত ২ বছরে তাঁকে আদালতে আনার সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল কারাবন্দী জাকির খানও ছিলেন অনুসারীদের কাছে জনপ্রিয়। আর বিএনপি ভেঙে তৃণমূল করা তৈমূর নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে দিয়েছেন। অথচ সঠিক ট্র্যাকে থাকলে ৫ আগস্টের পর তৈমূর থাকতেন শিরোমণিতে।
রায় ঘোষণার দিন তৈমূর ছিলেন না আদালতপাড়াতে। সাব্বির কন্যা ফাতেমা তুজ জোহরা শবনম ঢুকরে কেঁদেছেন রায়ের পর। বিপরীতে উল্লাস ছিল জাকির বলয়ে।
দেখা দেয় এক নতুন প্রশ্নের। তাহলে সাব্বিরকে হত্যা করলো কারা ? কারা ছিল সেই খুনী? যদি সাব্বির নিহত হয়ে থাকে কেন কারা তাকে হত্যা করেছিল। এর দায়ভার তাহলে কার। পরিবারের মামলা নাকি পুলিশের প্রতিবেদন।
সাব্বির আলম খন্দকারের মেয়ে অ্যাডভোকেট ফাতেমা তুজ জোহরা শবনম বলেন, আমার বাবার কাছে জাকির খানের সকল কুকর্ম ও অনৈতিক কাজে রেকর্ড ছিল। এই কারণেই আমার বাবাকে হত্যা করা হয়। আমার বাবা খুবই স্পষ্টভাষী ও সৎ সাহসী লোক ছিল। নারায়ণগঞ্জের লোকজন তাকে টাইগার বলতো। কারণ আমার বাবার মতো সাহস আর কারো ছিল না। আমার বাবা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেছে বলেই আমার বাবা আমাদের মাঝে নেই। জাকির খান আমার বাবার হত্যাকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে জানতো আমার বাবাকে মারা এতো সহজ হবে না। তাই সে একমাস আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিল। আমার বাবাকে হত্যা করার জন্য সে ক্রিমিনাল ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। আমার বাবাকে হত্যা করার আগেও কয়েকবার মারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি তখন। এমনকি আমাদের বাসাতেও কয়েকবার হামলা করেছিল তারা। এমন অত্যাচারের মধ্যেই আমরা থাকতাম।
আপনার মতামত লিখুন :