নারায়ণগঞ্জের আলোচিত জাকির খান কারামুক্ত হচ্ছে আগামীকাল রোববার। ২১ বছর পলাতক ও বন্দি থাকা পর ১৩ এপ্রিল সকাল ৮টায় নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে হচ্ছেন তিনি। আর আলোচিত নেতাকে বরণ করে নিতে লক্ষাধিক সমর্থকেরা ভোর থেকে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে সামনে উপস্থিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এদিকে কারমুক্ত জাকির খানকে নিয়ে লিংক রোড, চাষাঢ়া, ২নং রেলগেইট হয়ে দেওভোগে প্রবেশ করবেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সহ সমর্থকরা। অন্যদিকে তার মুক্তি পর জাকির খানের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে দেখে প্রতিপক্ষরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন বলে জানা গেছে।
আলোচিত ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলাসহ চারটি হত্যা মামলাসহ মোট ৩৩ মামলার আসামি ছিলেন জাকির খান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর র্যাব-১১ এর একটি অভিযানে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন মামলায় জামিন পান তিনি। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সাব্বির আলম হত্যা মামলার রায়ে তিনি এবং মামলার অন্য আসামিরা খালাস পান।
সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলায় ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের মাসদাইর এলাকায় নিজ বাড়ির অদূরে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন সাব্বির আলম খন্দকার। হত্যাকাণ্ডের পর তার বড় ভাই তৈমুর আলম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনের তৎকালীন বিএনপি দলীয় এমপি গিয়াসউদ্দিনকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলা জাকির খান, তার দুই ছোট ভাই মামুন খান ও জিকু সহ একাধিক আসামী করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ৩৪ মাস তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে ৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন। এ চার্জশিটে মামলার প্রধান আসামি গিয়াস উদ্দিনকে মামলা থেকে বাদ দেয়া হলে প্রধান আসামী হন জাকির খান। পরে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি হয়। সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা সময়ে ভারতে চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে আদালতে স্বাক্ষী প্রমাণে সূত্রে জানা যায়। এরপর থেকে তিনি পলাতক জীবনে গেলে নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে রাজনীতি জীবন থেকে ছিটকে পড়েন।
জাকির খান ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতি গুরু জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি প্রয়াত নাসিম ওসমানের বিরোধ বাধে। পরে জাকির খান বিএনপি নেতা কামালউদ্দিন মৃধার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে দেওভোগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে শহরে পরিচিত পান জাকির খান। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে জাকির খান শহরের খাজা সুপার মার্কেটে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড পেয়ে জেলে যান। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্ত হন। সে সময়ের বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর নাতি হিসেবে শহরে পরিচিত হয়ে ওঠেন জাকির খান।
একই বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সাত মাসের মাথায় কাশীপুর বাংলাবাজার এলাকায় এক ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগে মামলা হয়। এই মামলায় দ্বিতীয় দফায় জাকির খানের পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এরপর আওয়ামী লীগের চার বছর ক্ষমতার সময় জাকির খান কারাবন্দি থাকেন। ১৯৯৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য জেল থেকে বের হয়ে জাকির খান জেলা ছাত্রদলের সভাপতির পদটি পেয়ে যান। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দিকে ২০০০ সালে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ থেকে টানবাজার ও নিমতলী পতিতালয় উচ্ছেদ করলে জাকির খানের পরিবারের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড’ ভেঙে যায়। ২০০১ সালে বিএনপির চারদলীয় জোটের ক্ষমতায় আসার পরও প্রায় পাঁচ মাস জাকির জেলে থাকেন।
২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি তৎকালীন বিকেএমইএর সহসভাপতি সাব্বির আলম খন্দকারকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন জাকির খান। তিনি দেশ ছেড়ে পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি হয়। এর জের ধরে দীর্ঘ ২১ বছর ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর দেশে ফিরে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন জাকির খান। এতে নিশ্চিত করেন র্যাব ১১ এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা। এর পর থেকে তিনি একাধিক মামলায় আদালতে চলমান হওয়ায় ৯৫২ দিন কারামুক্তি পাচ্ছেন আগামীকাল।
রাজনীতি জীবনে জাকির খান ছিলো আলোচিত। একাধিক সূত্রে জানা যায়, সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা ও মামলা দায়ের করা পর বিএনপির হাইকমান্ড জাকির খানকে আত্মসমর্পনের নিদের্শনা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ওই সময়ে ক্লিন হার্ট অভিযানে ক্রস ফায়ার ভয়ে তিনি থাইল্যান্ডে দীর্ঘ বছর সময় পাড় করেন। এতে হাইকমান্ড নাখোশ হওয়ায় ১৯৯৯ সালে তিনি জেলা ছাত্রদলের সভাপতি থেকে আর কোন পদ পায়নি দলের। গত দুই বছর যাবৎ তার সমর্থকরা মহানগর বিএনপি সভাপতি পদ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ বা ৫ আসনে বিএনপির এমপি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রচারণা ও বক্তব্যে দিয়ে যাচ্ছে। জাকির নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি একজন সদস্য না হয়েও তার স্বজনরা যুগ্ম আহবায়ক হয়েছেন। তার ছোট ভাই জিকু খান জাসাস নারায়ণগঞ্জ সদর থানা শাখার সভাপতি হয়েছেন। আরেক ছোট ভাই মামুন খান মৎসজীবী দলের সাথে জড়িত রয়েছেন।
আদালতপাড়ায় জাকির আসলে এক সময় গডফাদার খ্যাত নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শামীম ওসমানও ভয় পেতেন। প্রকাশ্যে সভা সমাবেশেই শামীম ওসমান বলতেন দেশের মধ্যে কাউকে ভয় পাই না। গালি দিয়ে বলতেন আমি একমাত্র জাকির খানকেই ভয় পাই।
২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দাবি করেছেন বাদী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। এসময় আদালতে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায়ও হাসতে দেখা গেছে জাকির খানকে। নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা-২ আদালতের বিচারক শাম্মী আক্তারের আদালতে সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এদিকে জাকির খানের আইনজীবী মো. রবিউল হোসেন জানান, আলোচিত ব্যবসায়ি নেতা সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন ও তৈমূর আলম খন্দকার ষড়যন্ত্র করে জাকির খানকে মামলার আসামি করেছেন।
অন্যদিকে ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির ৪১ সদস্য আহবায়ক কমিটি ঘোষনা করা হয়। ওসময়ে আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটিতে যুগ্ম আহবায়ক পদে জাকির খানের নাম কেটে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে তার সমর্থকরা। ওস্থানে জাকির খানের চাচা মনির হোসেন খানকে দেয়া হয়েছে বলে গুঞ্জন উঠে। এতে করে এক সময় সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন জাকির খানের নেতাকর্মীরা।
আপনার মতামত লিখুন :