News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

জাকির খানের কারামুক্তিতে সমর্থকদের আনন্দ নগরবাসীর আতঙ্ক


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | স্টাফ রিপোর্টার প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৫, ১০:২৩ পিএম জাকির খানের কারামুক্তিতে সমর্থকদের আনন্দ নগরবাসীর আতঙ্ক

নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আলোচিত সমালোচিত সেই জাকির খান এ সপ্তাহের রোববার ১৩ এপ্রিল কারামুক্ত হতে যাচ্ছে। তার কারামুক্ত হওয়ার খবরে তার অনুসারীদের মাঝে আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেলে নগরবাসীর মনে আতঙ্ক বাসা বাঁধতে শুরু করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৭ বছর নারায়ণগঞ্জবাসী এক গডফাদার পরিবারের জিম্মি কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর নতুন করে আরেক গডফাদারের কাছে জিম্মি হওয়ার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে নগরবাসী সহ ব্যবসায়ী মহলের মনে।

জানা গেছে, চারটি হত্যা মামলাসহ মোট ৩৩টি মামলার আসামি ছিলেন জাকির খান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর র‌্যাব-১১ এর একটি অভিযানে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন মামলায় জামিন পান তিনি। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সাব্বির আলম হত্যা মামলার রায়ে তিনি এবং মামলার অন্য আসামিরা খালাস পান।

২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট চলাকালীন সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি সাব্বির আলম খন্দকার খুন হওয়ার পর এ মামলার আসামি হওয়ায় তিনি নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে সুকুমবিকে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ’গ্রেস’ নামে ৮তলা বিশিষ্ট একটি থ্রি-স্টার হোটেল কিনে ব্যবসা পরিচালনা করেন। তবে দীর্ঘ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে নারায়ণগঞ্জে তার অনুসারীরা জাকির খানের নামের আতঙ্ক বজায় রেখে ছিলো। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জাকির খানের অনুসারীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে শুরু করে।

মূলত ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর তৈমুর আলম খন্দকার জেলা বিএনপির সভাপতি হওয়ার পর স্থানীয় বিএনপির কর্তৃত্ব তার কাছে চলে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপ তাদের অবস্থান সুসংহত করতেই জাকির খানকে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ওই গ্রুপের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল জেলা ও শহর বিএনপির কমিটিতে স্থান না পাওয়া বিতর্কিত কয়েকজন নেতা। এসব গ্রুপের মাধ্যমে সেসময় জাকির খান গোপনে ঢাকায় বিএনপির হাই কমান্ডের কয়েকজনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন বলেও জানা গেছে।

সেই সময়ের এমন ধারা অব্যাহত রয়েছে বর্তমান সময়েও। যারাই দলের পদ-পদবি বঞ্চিত হয়েছে তারাই ভিড়েছে জাকির খান বলয়ে।

বিএনপিতে তার কোনো পদ পদবী না থাকলেও বিএনপি সহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন  গুলোতে ইতোমধ্যেই তার প্রভাব লক্ষ্যনীয় হয়েছে।

জানা গেছে, তার রয়েছে বিশাল সমর্থক বাহিনী। এই সমর্থকদের বিরুদ্ধে শহরে নানা সময় বিভিন্ন বির্তকিত কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। শহরের সর্বত্র তার কর্মী সমর্থকদের ব্যানার ফেস্টুনে সয়লাব করেছে। পূর্বে শুধুমাত্র মৎসজীবী দলের জিয়া ও পারভেজ মল্লিক জাকির খানের নামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও বর্তমানে বিএনপি সহ সকল সহযোগী সংগঠনের নামে জাকির খানের পক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি শহর জুড়ে জাকির খান সমর্থকদের ব্যানার ফ্যাস্টুন দেখা গেছে সেখানে জাকির খান বাদে অন্য কাউকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, ছাত্রদল, মৎসজীবী দল, জাকির সমর্থক গোষ্ঠী, জাকির খান মুক্তি পরিষদ সহ বিভিন্ন সংগঠনের নামে ব্যানার ফেস্টুনে কোথাও স্থান পায়নি মহানগর বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পদধারী নেতারা। যারাই এসব ব্যানার ফেস্টুন সাটিয়েছেন  তারা সবাই জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানকেই প্রধান্য দিয়েছেন।

এসব অনুসারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষকে জাকির খানের নামে ভয় দেখানো, সহ নানা বিভিন্ন অনিয়ম ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। যা জাকির খানের মুক্তির পর আরো প্রকোট আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।

অন্যদিকে রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন বিএনপি দলীয় নেতারাও। কারণ জাকির খান ও তার অনুসারীদের অতীত রেকর্ড খুব বেশি ভাল নয়। সিনিয়র নেতৃবৃন্দরা জাকির খানের অনুসারীদের হাত অপদস্ত হতে পারে এমন আশঙ্খাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা। কারণ ইতোমধ্যে জাকির খানের অনুসারীরা নিজেরাই প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন যে দলের ভেতরে অনেক নেতারাই জাকির খানের মুক্তি নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তাদেরকে সময় মত উচিত জবাব দেওয়া হবে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রোববার মুক্তি পেতে যাচ্ছেন আলোচিত সমালোচিত জাকির খান। যাকে এক সময় রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি সন্ত্রাসী হিসেবেই জানতো নারায়ণগঞ্জ তথা দেশের মানুষ। ২২ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে জাকির খানের কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের এক সময়ের দোর্দন্ড প্রতাপশালী নেতা জাকির খানের বাবা দৌলত খান ছিলেন তৎকালীন টানবাজার পতিতালয়ের গডফাদার ছিলেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেন। সূত্রমতে, ১৯৮৯ সালে প্রয়াত নাসিম ওসমানের হাতে ধরে জাতীয় পার্টির ছাত্রসমাজে যোগ দিয়ে নারায়ণগঞ্জের ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জাকির খানের সঙ্গে নাসিম ওসমানের বিরোধ বাধে। পরে জাকির খান বিএনপি নেতা কামালউদ্দিন মৃধার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে দেওভোগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্ধর্ষ হিসেবে শহরে পরিচিত পান জাকির খান।

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে জাকির খান শহরের খাজা সুপার মার্কেটে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড পেয়ে জেলে যান। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্ত হন। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর নাতি হিসেবে শহরে পরিচিত হয়ে ওঠেন জাকির খান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ৭ মাসের মাথায় কাশীপুর বাংলাবাজার এলাকায় এক ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় দ্বিতীয় দফায় জাকির খানের ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং তিনি জেলে যান। আওয়ামী লীগের ৪ বছর জাকির খান থাকেন জেলে।

১৯৯৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য জেল থেকে বের হয়ে জাকির খান জেলা ছাত্রদলের সভাপতির পদটি পেয়ে যান। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দিকে ২০০০ সালে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ থেকে টানবাজার ও নিমতলী পতিতালয় উচ্ছেদ করলে জাকির খানের পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায় বলে সেসময় খবর ছড়ায়। বিশাল গাড়ী বহর নিয়ে অস্ত্রের মহড়া শুরু করলে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবার কারাবন্দি হন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও প্রায় ৫ মাস তিনি জেলে থাকেন।

স্থানীয় বিএনপির এক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের কাউন্টারম্যান হিসেবে জাকির খানকে বিএনপির রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা চালানো হয় জেলার সাবেক এমপি ও তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে। এই গ্রুপটি মূলত তৈমুর আলমের প্রতিপক্ষ গ্রুপ হিসেবে পরিচিত।

থাইল্যান্ডে হোটেল ব্যবসার মন্দাভাব থাকায় জাকির খান দেশে ফিরে আসতে চাইছিলেন অনেকদিন ধরেই। এ লক্ষ্যে দলের সকল কর্মসূচি ও জাতীয় দিবসগুলোতে দলের পক্ষে মিছিল ও শো ডাউন করে আসছিল জাকির খানের হাজারো লোকজন। তারা জাকির খানের বিশাল ছবি ও ব্যানার বহন করে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আসছিলেন।

প্রসঙ্গত, সাব্বির আলম খন্দকার ছিলেন দেশের গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ও সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই।

সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলায় ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের মাসদাইর এলাকায় নিজ বাড়ির অদূরে আততায়ীদের গুলিতে তিনি নিহত হন।

হত্যাকাণ্ডের পর তার বড় ভাই তৈমুর আলম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনের তৎকালীন বিএনপি দলীয় এমপি গিয়াসউদ্দিনকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৪ মাস তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে ৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন। এ চার্জশিটে মামলার প্রধান আসামি গিয়াস উদ্দিনকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ায় মামলার বাদী তৈমুর আলম খন্দকার সিআইডির দেওয়া চার্জশিটের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন।

নারাজি পিটিশনে তৈমুর আলম বলেন, ‘গিয়াসউদ্দিনই সাব্বির আলম হত্যাকাণ্ডের মুল নায়ক। গিয়াসউদ্দিন ও তার সহযোগীদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা একটি গোঁজামিলের চার্জশিট দাখিল করেছেন। পরবর্তীতে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। ’

এর পর থেকে ৬ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম আদালতে (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) মামলার শুনানি চলে আসছিল। গত ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে তৈমুর আলম খন্দকার আদালতে দাখিলকৃত না রাজি পিটিশনটি আবেদন করে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

নারাজি পিটিশন প্রত্যাহারের কারণে গিয়াসউদ্দিন এখন আর মামলায় অভিযুক্ত নেই। ফলে সিআইডি ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে যে ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করেই মামলাটি পরিচালিত হয়।

সব শেষ সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলা থেকে জাকির খান সহ সবাইকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত।

এ মামলায় খালাস পাওয়া অন্যান্য আসামিরা হলেন জাকির খানের দুই ছোটভাই জিকু খান ও মামুন খান, তার সহযোগী জঙ্গল ওরফে লিটন, মোক্তার হোসেন, নাজির আহমেদ, আব্দুল আজিজ এবং মৃত মনিরুজ্জামান শাহীন।

Islam's Group