নারায়ণগঞ্জে গত ১০ বছর ধরে প্রধান সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক। পাড়া মহল্লার অলিগলি থেকে শুরু করে মুদি দোকানের আড়ালেও চলছে মাদক ব্যবসা। দিনরাত এসব মাদক গ্রহণ করছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। বার বার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, চালান জব্দ করেও থামানো যায়নি মাদকের বিস্তার। দিন দিন মাদকের প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে মাদকের বিস্তার এই জেলার মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সম্প্রতি মাদকের প্রভাবের জঘন্য রূপ দেখতে পেয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী। গত শুক্রবার দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জে বাড়ির সামনের রাস্তায় ইট সুরকি দিয়ে ঢেকে রাখা তিনটি খন্ডবিখন্ড মরদেহ প্রমাণ করে মাদকের ভয়াল রূপ কতটা বিভৎস। এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে হত্যার কথা স্বীকার করেছে ইয়াসিন (২৪)।
নিহতরা হলেন, ইয়াসিনের স্ত্রী লামিয়া (২২) তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ (৪) এবং লামিয়ার বড় বোন স্বপ্না (৩৫)। নিহত লামিয়ার বোন মুনমুন বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে লামিয়ার সাথে ইয়াসিনের বিয়ে হয়। বিয়ের পরপরেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে ইয়াসিন। কোন কাজ কর্ম করতো না সে। উল্টো মাদকের টাকা চেয়ে মারধর ও যৌতুক চাইতো। শুধু তাই নয়, লামিয়ার শ্বশুর ও ননদও তাকে মারধর করতো টাকার জন্য। এসব কারণে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতো লামিয়া।
চলতি মাসের ১ তারিখ সিদ্ধিরগঞ্জ মিজমিজি পশ্চিম পাড়া বড়বাড়ি এলাকায় বাসা ভাড়া নেয় লামিয়া। মানসিক ভারসাম্যহীন বড় বোনের কাছে ছেলেকে রেখে কাজ করতেন সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকার একটি কারখানায়। সেখান থেকে আয় রোজগার করেই নিজের সংসারের খরচ বহন করতেন। এরই মধ্যে ৬ এপ্রিল জেল থেকে ছাড়া পায় মাদকাসক্ত ইয়াসিন। লামিয়ার কাছে ফিরে আসে নেশা না করার শর্তে।
লামিয়ার ঘরে নতুন ব্যক্তি দেখে বিষয়টি নজরে আসে বাড়িওয়ালার। জানতে চায় কে এই ব্যক্তি? লামিয়া অকপটে স্বীকার করে নেয় তাঁর স্বামীর পরিচয় এবং জানিয়ে দেয় সে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ৭ এপ্রিলের পর থেকেই নিখোঁজ ছিলো লামিয়া। বাড়িওয়ালা ঘর তালা দেয়া দেখে ভেবেছিলেন গ্রামের বাড়িতে গেছেন ঈদের ছুটিতে। কিন্তু চারদিন পর বাড়ির সামনেই পাওয়া যায় খন্ডবিখন্ড লাশ।
হত্যাকান্ডের চারদিনেও এলাকা ছেড়ে পালায়নি ঘাতক ইয়াসিন। মিজমিজি এলাকাতেই ঘোরাঘুরি করছিলেন। লাশ উদ্ধারের পর বিকেলে তাকে মিজমিজি কলাপাড়া থেকে আটক করে পুলিশ। তদন্তে যুক্ত থাকা সিদ্ধিরগঞ্জ থাকার এক কর্মকর্তা জানান, ইয়াসিন ভয়াবহ মাদকাসক্ত। সে নিজের স্ত্রী ও স্ত্রীর বড় বোনকে হত্যা করে খন্ড বিখন্ড করেছে। নিজের ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। হত্যার পর বেশি দুরেও লাশ গুম করেনি। নিজের ঘর থেকে মাত্র ২০ ফুট দ‚রে নিয়ে ইট সুরকি দিয়ে ধামাচাপা দিয়ে রাখে। হত্যার পর বহু আসামি দ‚রে পালিয়ে গেলেও ইয়াসিন কোথাও পালায়নি। উল্টো এলাকাতেই ঘোরাঘুরি করছিলো। মাদকাসক্ত হবার কারণেই তাঁর এই ধরণের বিবেক বুদ্ধি কাজ করেনি।
পুলিশ আরও জানায়, ধারণা করা হচ্ছে মাদকের টাকা না পেয়েই হত্যাকান্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে ইয়াসিন। এরপরেও মামলায় যেহেতু আরও দুজনের নাম যুক্ত হয়েছে, তাদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টিও খতিয় দেখা হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, মাদকের প্রভাব যে ভয়াবহ তা আমরা জানি। মাদকসেবী একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। তাঁরই নির্মম একটি উদাহরন হচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জে মা ছেলে সহ তিনজন হত্যাকান্ডের ঘটনা। আমরা এই ঘটনার জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই যে, এই রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মাদক নির্মূলে ব্যর্থ। মাদক নিয়ে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও পাড়া মহল্লায় মাদক ছড়িয়ে পড়ছে অবাধে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে এই মাদকের প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
আপনার মতামত লিখুন :