নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক নাসিক ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন এবার বিএনপির আশীর্বাদ চাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা চাচ্ছেন বিএনপির নেতাদের ম্যানেজ করে আলোচিত এ মামলা থেকে খালাস পেতে। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে একটি মার্কেটও তারা যে কোন মূল্যে দখল করতে চাচ্ছে। এসব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
একাধিক সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর থেকে কারাগারে থাকা নূর হোসেনের অনুসারী অনেকেই বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। বিশেষ করে জেলা বিএনপির সবশেষ কমিটি ঘোষণার পর তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। যোগাযোগ করে নূর হোসেনের অনুসারীরা সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে বদরউদ্দিন মার্কেটটি দখল করার চেষ্টা করছেন। এ মার্কেট এখন গিয়াসউদ্দিনের নিয়ন্ত্রনে।
ওই সূত্রটি জানায়, নূর হোসেন এখন বিএনপির আশীর্বাদ চায়। সম্প্রতি সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খান ৩৩ মামলার সবগুলো থেকে জামিন ও খালাস সহ সাজাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পান। ১৩ এপ্রিল মুক্তির খবরও নূর হোসেন পেয়েছেন। এ কারণেই তিনি একটু উচ্ছ্বাসিত। এ কারণেই অনুসারীরা বিএনপির বিভিন্নস্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
জানা গেছে, এক সময়ের ট্রাকচালক নূর হোসেন ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই সিদ্ধিরগঞ্জে টাকার রাজ্য ও নানা অপরাধের সাম্ম্রাজ্য গড়ে তুলে। সেই সাম্ম্রাজ্যের অর্জিত টাকার ভাগ যেমন আওয়ামী লীগের নেতা, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা পেত তেমনি টাকার একটি ভাগ যেত স্থানীয় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পকেটে। বিএনপি নেতারা শুধু নূর হোসেনের টাকাই নয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপিকে আলিশান কার্যালয় করে দিয়েছিল নূর হোসেন।
নূর হোসেনের আমলে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদেরকে নূর হোসেনের আস্তানায় দেখা গেছে অনেকবার। মাঝারি সারির নেতাদেরকে দিয়ে শীর্ষ নেতারা নিয়মিত মাসোহারাও নিত। কয়েক বছর পূর্বে শিমরাইলে হেফাজতের লংমার্চ সহ অন্য কর্মসূচিতেও নূর হোসেন মোটা অংকের টাকা প্রদান করেছিল। সেভেন মার্ডারের পর তদন্ত করতে গিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা এসব তথ্য পেয়েছিল।
নূর হোসেনের আপন বড় ভাই মিয়া মোহাম্মদ নূর উদ্দিন ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জে থানা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক। মূলত তার সূত্র ধরেই নূর হোসেনের সঙ্গে কানেকশন ছিল বিএনপি নেতাদের। সম্পৃক্ত নেতাদের মধ্যে ওই সময়ে ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলমের ঘনিষ্টতা ছিল বেশি। যে কারণে নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ শিমরাইলে আলিশান ভবনে বিশাল একটি বিএনপি কার্যালয় করে দেন। ওই কার্যালয়টি ভাড়া ও অগ্রিম পরিশোধের ব্যবস্থা করেছিলেন নূর হোসেন। সাত খুনের ঘটনায় ভারতে নূর হোসেন পালিয়ে গেলে বিএনপির কার্যালয়টি আবারো ভবন মালিক দখলে নেয়। যে কারণে ওই কার্যালয়টি এখন বিএনপির নেই।
সাত খুনের পর নূর হোসেনের ছোট ভাই নুরুদ্দিন পলাতক ছিল। নূর হোসেনের সাজা হওয়ার পর প্রকাশ্যে আসে নুরউদ্দীন। নুরউদ্দীন বিএনপির রাজনীতি করলেও এ সরকারের আমলেই বড় ভাই নূর হোসেনের কারিশমায় শটগানের লাইসেন্স পায়। যদিও পরবর্তীতে প্রশাসন সেই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়।
ওই সময় নেতাকর্মীরা বলেছিলেন, নূর হোসেনের অন্যতম প্রতিপক্ষ বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনকে কোনটাসা করতেই সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপি নেতাদের টাকা দিয়ে চাঙ্গা রাখতো নূর হোসেন। গিয়াসউদ্দিন যাতে বিএনপির আলোচনায় আসতে না পারে সেজন্য জেলা বিএনপির একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে তরুণ দলের এক নেতা মাধ্যমে পরোক্ষ সখ্যতা গড়ে তুলে নূর হোসেন। আর সে সূত্র ধরেই নূর হোসেনের ভাই মিয়া নূরউদ্দিনকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক করা হয়। ওই সময় জেলা বিএনপির সেক্রেটারি ছিলেন সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির এবং ওই কমিটিতেও জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন শিল্পপতি মুহাম্মদ শাহআলম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহ আলমের সঙ্গে নূরউদ্দিনের ছিল ভালো সম্পর্ক। নূরউদ্দিন সিদ্ধিরগঞ্জের রাজনীতি করলেও ফতুল্লাতে ছিল তার দাপট। কুতুবপুরের বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম পান্না মোল্লার বন্ধু নূরউদ্দিনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল শাহআলমের ফতুল্লার বাসাতে। এর রেশ ধরেই নূর হোসেনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে শাহআলম। যার ফলশ্রুতিতে নূর হোসেনের গানম্যান আনোয়ার হোসেন আশিককে করা হয়েছিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানা শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় নূর হোসেনের গানম্যান আনোয়ার হোসেন আশিক সিদ্ধিরগঞ্জে শাহআলমের ব্যানার পোস্টার ফ্যাস্টুন লাগাতেন।
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার সহ ৭ জনের লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের অভিযানে নূর হোসেনের ওই বিলাসবহুল বাড়ি থেকে রক্তমাখা হাইএস গাড়ি উদ্ধার সহ ১৬ জনকে আটক করা হয়েছিল। ওই মামলায় আনোয়ার হোসেন আশিককেও আসামি করা হয়েছিল। তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।
আরও জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা তরুণ দলের সভাপতি টিএইচ তোফার মাধ্যমে নূর হোসেনের সঙ্গে লিয়াজো করাতো বিএনপির শীর্ষ নেতারা। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির বেশকজন শীর্ষ নেতার পকেটে।
এছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির বেশকজন নেতাও নূর হোসেনের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগীতা নিতো। মূলত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে যাতে গিয়াসউদ্দীন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে লক্ষ্যেই শাহআলম ও নূর হোসেনের মধ্যে লিয়োজা করা হয়। তবে শাহআলমের কাছ থেকে নূর হোসেন টাকা না দিলেও প্রতি ঈদে শাহআলম নূর হোসেনকে বিশেষ পাঞ্জাবি উপহার দিতো। যে পাঞ্জাবি শুধুমাত্র একটি গার্মেন্টস থেকে নূর হোসেনের জন্য একটি পাঞ্জাবিই বানানো হতো।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল এ নির্মম ঘটনা ঘটে। সেদিন নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকারযোগে ফিরছিলেন নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একইসময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করে। ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ জনকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিলো ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামীদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দু’টি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দু’টি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭ জন করে। যার মধ্যে দু’টি মামলার বাদি, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী সকাল ১০টা ৪মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকুরীচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব:) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব:) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব:) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামীকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। পরবর্তীতে ২০১৭ সালেল ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জাকির জানান, এই মামলা নিয়ে বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। এই মামলা যেনো শিঘ্রই নিষ্পত্তি হয় সেজন্য তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বারবার আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, এই মামলার আসামিরা কোনোভাবেই কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। বরং বাদীপক্ষ নিম্ন আদালতে, সুপ্রীম কোর্টে যেমনিভাবে ন্যায়বিচার পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে লিভ টু আপিল বিভাগে আসামিদের চূড়ান্ত শাস্তি বহাল থাকার বিষয়ে রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :